বিগত কয়েক মাসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বেশ তেজিভাব লক্ষ করা গেছে। গত ২৫ অক্টোবর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ মূল্যসূচক (ডিজিইএন) সর্বকালের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে। ২৬ তারিখে সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ৩৩১১ পয়েন্ট, যা জুলাই মাসের শুরুর মূল্যসূচক থেকে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে পুঁজিবাজার থেকে এই পরিমাণ মুনাফা সামান্য ব্যাপার নয়। আমাদের পুঁজিবাজারে গত বছরের আয়ের তুলনায় এখনকার মূল্য প্রায় ২০ গুণ, অর্থাত্ পুঁজিবাজারের এখনকার মূল্য আয় (পিই) অনুপাত ২০×। পিই অনুপাত পুঁজিবাজারের মূল্যমানের একটি বহুল প্রচলিত নির্দেশক। পিই অনুপাত সাধারণভাবে বোঝায়, কত বছরের আয় একসঙ্গে যোগ করলে একটি শেয়ারে আপনার বিনিয়োগ সম্পূর্ণভাবে ফেরত পাবেন। পুঁজিবাজারের সঙ্গে তুলনা করুন অন্য যেকোনো বিনিয়োগের, যেমন—পোলট্রি ফার্ম। বিনিয়োগ ফেরত পেতে আপনি কি ততদিন অপেক্ষা করতে রাজি?
আজকের তুলনায় ২০০৯ সালের শুরুতে পুঁজিবাজারের পিই অনুপাত ছিল ১৮.৪×, ২০০৭ সালের শুরুতে ছিল ১৪.৫×। শেয়ারের দাম বা মূল্যসূচকের এ ধরনের ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও কারও পক্ষে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অতি মূল্যায়িত বা শেয়ারের দাম অতিরিক্ত বেশি। পুঁজিবাজারে মূল্যমানের অনেকগুলো নির্ধারক আছে, যেমন: আগামী বছর লাভের সম্ভাবনা, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, সুদের হার, মূল্যস্ফীতির হার, বাজারে অর্থের জোগান (সরবরাহ), পুঁজিবাজার ছাড়া অন্যান্য বিনিয়োগে মুনাফার হার ইত্যাদি। এই নিয়ামকগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে শেয়ারের মূল্যমান সম্পর্কে আগাম ধারণা করা বা সুনির্দিষ্ট মত দেওয়া কঠিন।
তার পরও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এক ধরনের শেয়ার সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, এগুলো অতি উচ্চমূল্যে লেনদেন হচ্ছে। বর্তমানে মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটগুলো যে দামে বিক্রি হয়, তা কোনো যুক্তিতেই স্বাভাবিক নয়। পুঁজিবাজারে ১৭টি মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট গড়ে তাদের নিট সম্পদমূল্যের ২ দশমিক ৮ গুণ এবং গত বছরের আয়ের ৭৫ গুণ বেশি দামে লেনদেন হচ্ছে। এর সঙ্গে আমরা তুলনা করেছি এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ২১টি মিউচুয়াল ফান্ডের দাম। এই ২১টি ফান্ড তাদের নিট সম্পদমূল্যের শূন্য দশমিক ৯১ গুণ দামে বা নিট সম্পদমূল্যের কমে লেনদেন হচ্ছে। বাস্তবে নিট সম্পদমূল্যের থেকে বেশি দামে মিউচুয়াল ফান্ড লেনদেন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
কোনো নির্দিষ্ট দিনে মিউচুয়াল ফান্ডের নিট সম্পদমূল্য নির্ধারিত হয় এভাবে: মিউচুয়াল ফান্ডের অধিকৃত শেয়ার বা অন্য সম্পদের মোট মূল্য থেকে মোট দায় বিয়োগ করে পাওয়া যায় নিট সম্পদ। এই সংখ্যাকে মিউচুয়াল ফান্ডের মোট ইউনিটসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে ফান্ডের ইউনিটপ্রতি নিট সম্পদমূল্য পাওয়া যায়। মিউচুয়াল ফান্ডের একটি ইউনিট বলতে তাই বোঝায় এক ঝুড়ি শেয়ারের আংশিক মালিকানা।
বোঝার সুবিধার জন্য একে তুলনা করা যায় এক ঝুড়ি ফলের সঙ্গে, যেখানে আছে এক ডজন কলা, ছয়টি আপেল ও ছয়টি কমলা। ধরুন, খোলাবাজারে কলা, আপেল ও কমলার ডজনের দাম যথাক্রমে ৯০, ১৭০ ও ১৭০ টাকা। ঝুড়িটির দাম যদি হয় ২০ টাকা, তাহলে সেই এক ঝুড়ি ফলের মোট মূল্য হওয়া উচিত ২৮০ টাকা। যদি এই ঝুড়ি বাজারে বিক্রি হয়, তাহলে আপনি কি তা ৩০০, ৪০০ বা ৫০০ টাকা দিয়ে কিনবেন? পুঁজিবাজারের মূল্যমান অনুযায়ী প্রতিটি ঝুড়ি এখন লেনদেন হয় গড়ে ৭৮৪ টাকা বা নিট সম্পদমূল্যের ২ দশমিক ৮ গুণ বেশি দামে। যদি খোলাবাজার থেকে ফল কিনে ঝুড়িটি আপনি নিজে তৈরি করে নিতে পারেন, তবে এই অতিরিক্ত মূল্য দেওয়ার কোনো কারণ আছে কি? মিউচুয়াল ফান্ডের বেলায় একই কথা খাটে। কারও কারও মতে, ফান্ডের ম্যানেজার বা তহবিল ব্যবস্থাপক তাঁর ভালো শেয়ার চেনার দক্ষতা দিয়ে ফান্ডের ভবিষ্যত্ সাফল্য নিশ্চিত করেন, তাই এই উচ্চমূল্য। বাস্তবে ফান্ডের অধিকৃত যেসব মানসম্পন্ন শেয়ারের ওপর ফান্ডের ভবিষ্যত্ সাফল্য নির্ভর করে, তাদের স্বতন্ত্র মূল্যেই এই ভবিষ্যত্ সাফল্য প্রতিফলিত হয়। যেহেতু ফান্ডের নিট সম্পদমূল্য একক শেয়ারগুলোর মূল্যের যোগফল, তাই দ্বিতীয়বার ফান্ডের মূল্য বাড়ার কোনো সুযোগ নেই।
ফান্ডের মূল্য যে নিট সম্পদমূল্যের চেয়ে বেশি হওয়ার কোনো কারণ নেই, এটি অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারে সবাই বোঝে। কেবল ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ভিন্ন প্রকৃতির’ এই অমোঘ সত্যটি বোঝানোর জন্য আরও দুটি যুক্তির আমদানি করা হয়। প্রথমটি হলো মিউচুয়াল ফান্ড সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের মামলা। এখন আদালতের রায় যেদিকেই যাক না কেন, তা মিউচুয়াল ফান্ডের দামকে প্রভাবিত করার কোনো কারণ নেই। লভ্যাংশ দেওয়া হলে তা দেওয়া হবে ফান্ডের মোট সম্পদ থেকে, অর্থাত্ লভ্যাংশ দেওয়ার পর ফান্ডের সম্পদমূল্য এবং বাজারমূল্য ঠিক সেই পরিমাণেই কমে যাবে। এ ছাড়া আমাদের পুঁজিবাজারে যে বোনাস শেয়ার দেওয়া হয়, সেটাও মূলত অর্থহীন। বোনাস শেয়ার হচ্ছে কোম্পানির পুঁজির (ক্যাপিটাল) পুনর্বিন্যাস, যে পুঁজির মালিক এমনিতেই শেয়ারের ক্রেতারা। বোনাস শেয়ার দেওয়ার মাধ্যমে ব্যবসার লাভ যেমন বাড়ে না, তেমনি শেয়ারের ক্রেতাদেরও কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয় না।
ফান্ড ইউনিটের উচ্চমূল্যের আরও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় আইপিওতে মিউচুয়াল ফান্ডের জন্য সংরক্ষিত শেয়ারের বিষয়টিকে। আমাদের সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী যেকোনো আইপিওর ১০ শতাংশ শেয়ার মিউচুয়াল ফান্ডের জন্য সংরক্ষিত। এটি নিশ্চিয় ফান্ড ইউনিটের দামকে প্রভাবিত করে, কিন্তু কতখানি? গত বছর পুঁজিবাজারে ১৬টি আইপিওর মোট মূল্য ছিল ৪১০ কোটি টাকা। আমরা যদি ধরে নিই, এর ১০ শতাংশ সে সময়কার ১৪টি মিউচুয়াল ফান্ডকে বিতরণ করা হয় এবং এই শেয়ারগুলোর মূল্য আইপিওতে ইস্যুকৃত মূল্য থেকে গড়ে ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তাহলেও আইপিওর শেয়ার থেকে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর লাভ হবে পাঁচ শতাংশেরও কম এবং তা কোনো অবস্থায়ই ১৮০ শতাংশ উচ্চমূল্যকে সমর্থন করে না। অধিকন্তু, বাজারে মিউচুয়াল ফান্ডের ক্রমবর্ধমান সরবরাহ ভবিষ্যতে আইপিও থেকে প্রাপ্ত লাভকে কমিয়ে আনবে।
মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বাজারে নতুন মিউচুয়াল ফান্ড চালু করার মতো সহজ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি একটি নাটকীয় মাত্রা পেয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ডটি কোন শেয়ার বা সম্পদে বিনিয়োগ করছে, তার চেয়ে বেশি জরুরি তথ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে কারা এর বরাদ্দ পাচ্ছেন। অতি সৌভাগ্যবানেরা বরাদ্দ পাওয়ার পরপরই এই ফান্ড ইউনিট বিক্রি করছেন প্রায় আকাশছোঁয়া ২০০ শতাংশ লাভে। কিন্তু এটাও সত্য, আইপিও-পরবর্তী বাজারে (সেকেন্ডারি মার্কেট) প্রকৃত মূল্যের এত ওপরে বিনিয়োগ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন মিউচুয়াল ফান্ডের দাম তাদের সম্পদমূল্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়ে আসবে, তখন বেশি দামে কেনা অনেক বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সাধারণভাবে বিনিয়োগকারীরা মনে করতে শুরু করবেন, মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করাটা লাভজনক নয়। তাতে করে দেশি পুঁজি জোগানের এই সম্ভাবনাময় বাহনটির হয়তো অকালমৃত্যু ঘটবে।
এ ক্ষেত্রে সরকার বা পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর খুব বেশি কিছু করণীয় নেই। বিনিয়োগকারী স্বেচ্ছায় কত দামে শেয়ার বা অন্য কোন সিকিউরিটি কেনেন, তা সরকার নির্ধারণ বা নিয়ন্ত্রণ করে না এবং মুক্তবাজার অর্থনীতিতে তা কাঙ্ক্ষিতও নয়। এ ক্ষেত্রে একমাত্র রক্ষাকবচ হচ্ছে ‘ক্রেতা সাবধান’ এই সতর্কতা। বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই বাজারে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রবৃত্তি এড়ানো সম্ভব।
এমন নয় যে, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা কাণ্ডজ্ঞানের ধার ধারেন না, তাঁরা কেউই ২৮০ টাকার ফলের ঝুড়ি ৭৮০ টাকায় কিনবেন না অথবা এমন কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করবেন না, যেখানে বিনিয়োগের টাকা ফেরত পেতে ৭৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়। অবস্থা দেখে মনে হয়, কেবল পুঁজিবাজারে এলেই বিনিয়োগকারীদের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়। লোকে অতিমূল্যায়িত শেয়ার কেনে এই ভেবে যে, তার থেকে বড় বোকা তাঁর কাছ থেকে আরও বেশি দামে সেই শেয়ারটি কিনে নেবেন। কিন্তু মুক্ত ও স্বচ্ছ বাজারে কেউই যখন জানে না ঠিক কখন বিক্রি করাটা সবচেয়ে লাভজনক, তখন সম্ভাবনা থাকে, যে কেউই খালি ছালাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন এবং সবচেয়ে বড় বোকা বলে প্রমাণিত হবেন। তাই শেয়ার কেনার সময় একমাত্র বিবেচনা হওয়া উচিত ব্যবসার ধরন ও ভবিষ্যতের আয়ের সম্ভাবনা। মিউচুয়াল ফান্ডের বেলায়ও এ ধরনের বিবেচনার ব্যতিক্রম হওয়া উচিত নয়।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment